প্রবাসে সাহিত্য চর্চার চ্যালেঞ্জ
প্রকাশিতঃ আগস্ট ৪, ২০১৮, ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশ আর ভারতের বাংলা রাজ্যটির বাইরে আছে আরেকটি বিশাল বাংলা। সেটি প্রবাস বাংলা। আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে এই প্রবাসজীবন দুধারী তলোয়ারের মতো করে কাটে। একদিকে ভিনদেশে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের অনুভূতি নিয়ে বাঁচেন, প্রথম প্রজন্মের জন্য যা বেশি সত্যি। অন্যদিকে তারা হয়ে যান দেশীয় মূলস্রোতের বাইরের দ্বিতীয় শ্রেণির বাঙালি। অবশ্য দেশে থাকলে উচ্চতর বাঙালি রয়ে যায় আর প্রবাসে এলে মানের অবনতি হয়—তা সব সময় ঠিক নয়। বরং প্রবাসে এলে দেশের প্রতি, নিজস্ব জাতিগত পরিচয়, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি টান আরও গাঢ় হয়। প্রবাসীরা দৈনন্দিন চাল-ডালের হিসাবে তাল মেলানোর ব্যস্ততায় ডুবে থাকেন, খাপ খাইয়ে নেন ভিনদেশি সংস্কৃতি ও জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে। এভাবে কিছু সময় ভুলে থাকেন শিকড়ের কথা। কিন্তু আচার-আচরণ, শিষ্টাচার, উচ্চারণ, খাদ্যাভ্যাসে বাঙালি স্বাতন্ত্র্য ফুটে ওঠেই। একটু একান্ত অবসরে বা অন্য বাঙালির ভিড়ে সেটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
মূলত অর্থনৈতিক কারণেই বাঙালিরা প্রবাসে আসে বা থেকে যায়। প্রথম দিকে পড়াশোনা বা আয়-রোজগার, শেষে উন্নত জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ততা, নিরাপত্তা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নানামুখী টানাপোড়েনে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন স্বদেশ থেকে। শেষ জীবনে, বিশেষ করে যখন মানুষ অধিকতর স্মৃতিতাড়িত হয় তখন দেশের জন্য শিকড়ের জন্য প্রাণ আনচান করে। আলো-ঝলমলে মহানগরীতে বসেও ‘না ঘর কা, না ঘাটকা’—এমন আত্মপরিচয়হীনতার উপলব্ধি আরও বেশি করে পীড়া দেয়। জীবনের নিয়মে এক সময় একদিকে সন্তানেরা আলাদা হয়ে যায়, আবার পেছনে ফেলে আসা বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনদের অনেককেই আর দেশে গিয়ে ফিরে পাওয়া যায় না।
প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগা শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। যতই মেধাবী হোন না কেন, প্রবাসে এলে তাদের সৃষ্টিশীল সত্তাটি ছোট একটা গণ্ডির ভেতর আটকা পড়ে যায়। এর কারণ প্রথমত: ইতিমধ্যে তারা বাঙালি জীবনধারার মূল স্রোতের বাইরে চলে এসেছেন। দ্বিতীয়ত: বাংলা ভাষার মূল পাঠকদের বসবাস বাংলাদেশে বা ভারতের বাংলা প্রদেশে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে প্রবাসী কবি-লেখকদের লেখা একরকম দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পায়, মূলধারার বাংলা সাহিত্যের কাতারে তাকে ফেলা হয় না। সশরীরে দেশে না থাকায় প্রচারের আলোতে আসার সুযোগও কিছুটা কমে যায়। নবীন লেখকদের জন্য তা আরও কঠিন।
প্রশ্ন হতে পারে, শারীরিকভাবে দেশে না থাকলে কি পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় না? অন্তত এই উন্নততর তথ্যপ্রযুক্তির যুগে? এ আর এমন কি? লেখক কোথায় থাকল, না থাকল সেটি মুখ্য নয়, লেখাটিই তো মুখ্য। আসলে সমস্যা সেখানেই—যেটি খুবই জটিল এবং প্রায় দুর্লঙ্ঘ্য! এর পেছনে একদিকে দায়ী সেই প্রবাসী কবি বা লেখকের একধরনের মনস্তাত্ত্বিক বাধা, তেমনি দায়ী পাঠকের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। বাঙালি পাঠক বিদেশ থেকে বাংলা সাহিত্য ‘আমদানি’ করবে, সেটি এখনো কেউ ভাবতে পারে না, সেই পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এর পেছনে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতার অভাব দুটিই সমানভাবে কাজ করে। দেশি কবি-সাহিত্যিকদের কদরই বাঙালি পাঠকের কাছে বেশি।
একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
বিদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে বাংলায় সাহিত্য রচনা করলে দেশি পাঠকের কাছে তেমন আবেদন সৃষ্টি করে না, কারণ এই জীবনটি তার কাছে অপরিচিত। লেখা যতই মৌলিক হোক না কেন, বাঙালি পাঠকের কাছে সেটিকে অনুবাদ সাহিত্যের চেয়ে বেশি কিছু মনে হবে না। আবার, ভিনদেশি প্রেক্ষাপট নিয়ে একজন বাঙালি লেখক স্বাচ্ছন্দ্যে লিখতেও পারেন না। ধরা যাক, একজন সৌদি আরব প্রবাসী বাঙালি লেখক কী নিয়ে লিখবেন? সৌদি আরবের মানুষের মূল জীবনধারায়তো তার প্রবেশাধিকার নেই। এই জীবনটিকে তিনি পুরোপুরি ধারণও করেন না, মনে-প্রাণে বিশ্বাসও করেন না। এই সীমাবদ্ধতাটিকে এক-দুই প্রজন্মে কাটিয়ে ওঠা যায় না। আর যদি কিছুটা তথ্য থাকেও, সেটির ওপর ভিত্তি করে কত দূর টানা যায়? কৌতূহলী পাঠকের কাছে সে লেখা নতুন কিছু জানার উৎস হিসেবে যতটা কদর পেতে পারে, মূলধারার সাহিত্য হিসেবে কদর পাবে না।
তাহলে আর কী রইল? প্রবাসে মূল স্রোতের বাইরে যে একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাঙালি জীবনের গণ্ডি, সেই খণ্ডিত জীবন নিয়ে হয়তো সাহিত্য রচনা করা যায়, যেটি বড়জোর দিনলিপির মতো করে ফেসবুকে লেখা হয়—আর দেশীয় পাঠক সেই রোজনামচা একটু ঘেঁটে-ঘুঁটে দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এসব কারণে প্রবাসী লেখকের লেখার প্রেক্ষাপট বিচারে বাঙালি পাঠকসমাজে মূলধারার সাহিত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। অন্য সমস্যাটি বিশ্বাসযোগ্যতার। প্রবাসী লেখক দেশি পরিপ্রেক্ষিত অবলম্বন করে লিখলেও লেখাটি শেষ পর্যন্ত দেশি পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। ধরুন প্রবাসী কোনো বাঙালি লেখক বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখলেও একজন দেশি সাংবাদিক বা বিশ্লেষকের মতো ‘সিরিয়াস’ লেখার কদর সেটি পাবে না। পাঠকের ধারণা, লেখক বিদেশে থাকেন, দেশের বিষয়-আশয় রাজনীতি সম্পর্কে তিনি আর কতটুকুই খবর রাখেন বা জানেন বা বোঝেন! পাঠক সেটিকে ‘ভাসা-ভাসা’, ‘এমেচারিশ’, ‘কপি করা’, ‘ফরমায়েশি’ বা ‘তামদারি’ গোছের কিছু ধরে নেন।
তাহলে কী লিখবেন একজন প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যিক তার দেশি পাঠকের জন্য? কী আছে তার? কারও কারও মতে-‘প্রবাসী সাহিত্যিকেরা মূলত লেখালেখি করেন স্মৃতি বা নস্টালজিয়া থেকে। এঁদের মধ্যে যারা বড় মাপের কবি-সাহিত্যিক তাঁরাই কেবল স্মৃতি হাতড়ে বড় বড় ‘ম্যাজিক’ সৃষ্টি করতে পারেন’। কিন্তু, তেমন উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে হাতে গোনা। আর সে অর্থে সাফল্য প্রবাসী বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে একেবারে নেই বললেই চলে। স্মৃতি থেকে স্মৃতিকথা লেখা যায়। কিন্তু, দেশি পাঠক সেই সাহিত্যে নিজের সমকালীন জীবনের ছাপ দেখতে পান না। প্রবাস জীবন লেখকের হাত থেকে কেড়ে নেয় দেশি পাঠকের মনে ছাপ ফেলার ক্ষমতাটি। তাদের দুই-ধারার জীবনে হাসি-কান্না-আবেগ-অনুভূতি আর এক সুরে বেজে ওঠে না।
আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরী একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ১৯৭৮ সালে দেশ ছেড়ে হঠাৎ চলে আসা। মাতৃভূমি ছাড়তে নেই। একজন লেখকের মাতৃভূমি ত্যাগ করা আত্মহত্যার শামিল। দেশের নিত্যদিনের ঘটনাপ্রবাহ যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা একজন লেখকের জন্য জরুরি। আমি জীবনে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। তুমি অবশ্য বলতে পার মিলান কুন্ডেরার কথা। আইজ্যাক বশেভিচ সিঙ্গার, ভ্লাদিমির নভোকভ, জোসেফ ব্রডেস্কির কথা। আরও অনেকেই আছেন যারা মাতৃভূমির বাইরে বসেই লেখালেখি করেছেন। তবে আমাদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য হলো, এরা সবাই পাশ্চাত্যে লালিত। কেউ রাশিয়া থেকে পোল্যান্ড গেছেন, আবার কেউ ইউরোপ থেকে আমেরিকা। আর আমরা যারা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে এসেছি, তাদের শুরু শূন্য থেকে। আমাদের স্মৃতিতে থাকে দেশ, আর সামনে থাকে শূন্যতা। যে কারণে একজন লেখকের জন্য কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়।’ [উদ্ধৃতি: বাংলার মাটির গভীরে প্রোথিত আমার শিকড়: শহীদ কাদরী, দৈনিক সমকাল, ২৮ আগস্ট ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ]। কানাডা প্রবাসী একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি ইকবাল হাসান একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘ভিনদেশে বাস করাটা একজন বাঙালি কবির জন্য মৃতের কাফন পড়ে বেঁচে থাকার মতো’।
ইদানীং দ্রুততর সময়ে পরিচিতি পাওয়ার বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা থেকে কিছু কিছু প্রবাসী বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে দুটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এক. রাজনীতিকদের গালিগালাজ করে কিছু লেখা, অথবা দুই. রগরগে যৌনতা অবলম্বন করে লেখা। আহমদ ছফার কথা থেকে ধার করে বলি, ‘এসব লেখা চানাচুরের মতো মচমচে, কিন্তু এতে পুষ্টি নেই।’ বিনোদনের জন্য পাঠক এ-কে কিছুক্ষণ চিবিয়ে খায়, কিন্তু মনে রাখে না। লেখাগুলো শেষ পর্যন্ত সফল কবিতা বা সাহিত্যকর্ম হয়ে ওঠে না।
তাহলে পাঠকের কাছে যাওয়ার পথ কী?
অনবরত সাহিত্য-চর্চা করে যেতে হবে। আর চর্চার বড় অংশ জুড়ে থাকবে পাঠ। নিজেকে সমৃদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। পড়ার চেয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করার আর কোনো শর্ট-কাট পথ নেই। আর প্রবাসে বাংলা সাহিত্যকে সমাদৃত করতে হলে, প্রবাসে বাংলা পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষাকে সজীব করে তুলতে হবে। এই সত্যটি কঠিন হলেও অনস্বীকার্য। অবশ্য, সমরেশ মজুমদার স্বয়ং যেখানে আক্ষেপ করে বলেছেন, তাঁর নিজের কন্যাই ঠিকমতো বাংলা পড়তে জানে না, সে কখনো তাঁর কোনো বই পড়েনি—সেখানে প্রবাসী বাঙালিদের আর দোষ কী? তবু একদিন সেই দিনটি দেখে যেতে পারব—এই আশায় বাঁচি।
Leave a Reply