অরিত্রী মরিয়া কী প্রমাণ করিল?
প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ৬, ২০১৮, ৯:২২ পূর্বাহ্ণ
সন্তানের নিকট পিতা হইলেন সুপারম্যান। সুপারম্যান কি কখনো অপমানিত হন? কখনো অপদস্থ হন? কিন্তু যদি কখনো অপমানিত হন, আর তাহার কারণ যদি হয় সন্তান নিজে, অর্থাত্ সন্তানের কোনো ভুলের জন্য যদি বাবাকে অপমানিত হইতে হয়, তাহা হইলে সেই অপমান শত-সহস্র গুণ ভারী হইয়া গলার ফাঁসে পরিণত হয়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর ক্ষেত্রে ঘটনাটির পূর্বাপর অভিঘাত যেন এমনটিই ছিল।
অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাটি লইয়া ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হইয়াছে। সমালোচনার ঝড় উঠিয়াছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অরিত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচনায় জড়িত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখা প্রধান জিন্নাত আরা ও শিক্ষক হাসনা হেনা—এই তিনজনকে চিহ্নিত করিবার কথা গত বুধবার জানাইয়াছেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। সাময়িকভাবে বরখাস্ত করিবার পাশাপাশি ওই তিন শিক্ষকের এমপিও বাতিল করা হইয়াছে। ঘটনার বয়ানে অরিত্রীর পিতা দিলীপ অধিকারী জানাইয়াছেন যে, স্কুলে মোবাইল নেওয়া নিষেধ থাকা সত্ত্বেও অরিত্রী গত রবিবার মোবাইল ফোন লইয়া যায় পরীক্ষার হলে। পরীক্ষা চলাকালীন দায়িত্বরত শিক্ষকরা মোবাইলটি জব্দ করেন এবং অরিত্রীকে পরীক্ষার হল হইতে বাহির করিয়া দেন। সোমবার সকালে পরীক্ষা দিতে স্কুলে গেলে অরিত্রীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিতে না দিয়া তাহার পিতা-মাতাকে ডাকিয়া পাঠান স্কুল কর্তৃপক্ষ। অরিত্রীর পিতামাতা স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপালকে বলিয়াছেন যে, মোবাইলে অরিত্রী নকল করিবার জন্য তাহারা ক্ষমাপ্রার্থী। ভাইস প্রিন্সিপাল তাহাদের তখন প্রিন্সিপালের কক্ষে পাঠাইয়া দিলে সেইখানে অরিত্রীর পিতামাতা সন্তানের ভুলের জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু প্রিন্সিপাল তাহাতে সদয় হন নাই। বরং অরিত্রীকে টিসি (ছাড়পত্র) দেওয়ারও নির্দেশ দেন। নিজের কৃতকর্মের জন্য প্রিন্সিপালের দ্বারা পিতামাতার এমন অপমানের অভিঘাত সহ্য করিতে পারে নাই অরিত্রী। বাড়িতে গিয়া গলায় ফাঁস লাগাইয়া আত্মহত্যা করে এই মেধাবী শিক্ষার্থী। গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই ঘটনাকে ‘বাজে দৃষ্টান্ত’ ও ‘সাংঘাতিক ঘটনা’ বলিয়া বিস্ময় প্রকাশ করেন। বিষয়টিকে হূদয়বিদারকও বলেন মহামান্য আদালত। অরিত্রীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করিয়া বেইলি রোডে স্কুলের সম্মুখে বিক্ষোভ করিয়াছেন অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা। ‘এ কেমন শিক্ষা, যার জন্য শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়?’, ‘এ কি শুধু আত্মহত্যা?’, ‘আমরা আর অরিত্রী চাই না’—প্রভৃতি লেখা-সংবলিত প্ল্যাকার্ড লইয়া প্রতিবাদ জানান বিক্ষুব্ধ অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই অভিযোগ করিয়াছেন যে, ভিকারুননিসা নূন স্কুলে অরিত্রী এবং তাহার অভিভাবকদের সঙ্গে যে আচরণ করা হইয়াছে, এমন আচরণ এমন তারকাখচিত স্কুল-কলেজগুলিতে নিয়মিতই হইতেছে। অনেকে মনে করিতেছেন, মেধাবী ও সুন্দর মানসিক চিন্তা ও রুচির মানুষরা আসিতেছে না শিক্ষকতায়।
অরিত্রী শিশু। শিশুরা ভুল করিতেই পারে, কিন্তু সেই ভুল কি অমার্জনীয়? শিশুরা ক্ষমা চাহিয়াও ক্ষমা পাইবে না—বিদ্যালয়গুলিতে এমন নির্মম আচরণবিধি কীভাবে তৈরি হইল? অরিত্রী মরিয়া হয়তো বাঁচাইয়া দিয়া গেল আরো শত শত অরিত্রীকে। ইহা ছাড়া এই ঘটনার আর কোনো সান্ত্বনা নাই।
Leave a Reply